স্থুলতা (Obesity)
_________
👉 স্বাস্থ্যই সকল সুখের মুল- একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় প্রবচন । আগে সাধারণ মানুষের চোখে স্বাস্থ্যবান মানুষ বলতে দীর্ঘকায় ও মোটা-সােটা ব্যক্তিকে বোঝাত । জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে আমরা জানতে পেরেছি যে ‘মোটা- সোটা ব্যক্তি মানেই স্বাস্থ্যবান মানুষ নয়। স্বাস্থ্যের আধুনিক সংজ্ঞা হচ্ছে : রোগ-ব্যাধি বা অন্যান্য অস্বাভাবিক পরিস্থিতিমুক্ত শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক অবস্থাকে সাস্থ্য বলে । এ সঙ্গা অনুযায়ী, স্থূলতা কে অসুস্থতা হিসাবে বিবেচনা করে চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি নতুন শাখায় সৃষ্টি হয়েছে।
# 18, AMS OA RYG Y_4 (Mosby’s Medical Dictionary, 8th edition,2009)
আদর্শ দৈহিক ওজনের ২০% বা তারও বেশি পরিমাণ মেদ দেহে সঞ্চিত হলে তাকে স্থুলতা বলে।
স্থূলতা ফলে দেহের ওজন স্বাভাবিকভাবেবই বেড়ে যায়। পূর্ণবয়স্ক মানুষে দেহের মাত্রাতিরিক্ত ওজন নির্ধারণের জন্য উচ্চতা ও ওজনের যে আনুপাতিক হার উপস্থাপন করা হয় তাকে দেহের ওজন সূচক বা বডি মাস ইনডেক্স (Bodv Mass Index= BMI) বলে।BMI কে নিম্নরূপে প্রকাশ করাহলে তাকে স্থুলকায় বা মোটা বলা যাবে।
পাশাপাশি এই মান ১৮.৫ এর নিচে হলে তাকে নিমন মাত্রার ওজন ধরা হয়। তবে মাত্রা যদি ৫০-১০০ হয় তবে এই স্থুলতাকে মরবিড স্কুলতা (morbid obesity) বা ব্যাধিগ্রস্থ বিভৎ্স স্থূলতা বলে। ২০০০ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) BMI-এর এই মান নির্দেশিকা প্রকাশ করে। এর সাহায্যে অতি সহজে মানুষের স্থলতা নির্ণয় করা যায়। BMI-এর মান নির্দেশিকাটি নিচের ছকে প্রকাশ করা হলো –
ক্রমিক - বি এম আই - মানুষের শ্রেণি
1. <18.5 kg/m² - শরীরের ওজন কম
2. 18.5-24.99 kg/m² - সাভাবিক ওজন
3. 25.0-29.99 kg/m² - অতিরিক্ত ওজন
4. 30.0-34.99 kg/m² - ১ম শেণির ঝুকিপূর্ণ স্থলতা (Class I obesity)
5. 35.0 -39.99 kg/m² - ২য় শেণির ঝুকিপূর্ণ স্থলতা (Class II obesity)
6. >40.0 kg/m² - ৩য় শেণির ঝুকিপূর্ণ স্থলতা (Class III obesity)
স্থলতার ব্যাপকতায় সারা পথিবীর চিকিৎসা ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে আজ স্থুলতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ প্রক্ষিতে
চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি শাখাও সৃষ্টি হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে শাখায় স্থুলতার কারণ, প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও অস্ত্রপ্রচার সম্বন্ধে আলোচনা করা হয় তাকে বৈরিয়াট্রিকস (Bariatrics) বলে। স্থুলতার কারণে যে সব রোগ হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে-করোনারি হৃদরোগ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, ক্যান্সার (স্তন, কোলন), উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, যকৃত ও পিত্তথলির অসুখ, স্লিপ এ্যাপনিয়া, অস্টিও আর্থাইটিস, বন্ধ্যাত্ব ইত্যাদি ।
স্থুলতার কারণ (Causes of Ohesity):
ব্যাক্তি পর্যায়ে আতারিক্ত ক্যালীরি গ্রহণ, কিন্তু পর্যাপ্ত কায়িক পরিশম না করাকে স্থুলতার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে, সামজিক পর্যায়ে সুলভ ও মুজাদার খাবার, গাড়ীর উপর নির্ভরতা বেড়ে যাওয়া এবং উৎপাদন যগ্রের ব্যাপিক ব্যবহারকে স্থুলতা বৃদ্ধির কারণ বলে মনে করা হয়। তবে চিকিতসাবিজ্ঞানীরা যে সব কারণকে স্থুলতার জন্য বিশেষভাবে দায়ী করেছেন তা নিচে উল্লেখ করা হলো ।
১. জিনগত: সকল বিপাক এবং মেদ সঞ্চয় ও বিস্তারের ক্ষেত্রে গুচ্ছ জিন কাজ করে । স্থূলকায় বাবামায়ের সন্তান প্রায় ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে স্থূলকায় হয় । নিম্ন বিপাক হার এবং জিনগত সংবেদনশীলতা স্থুলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।
২. পারিবারিক জীবন্যাত্রা : পরিবারের জীবনযাত্রার উপর স্থুলতা প্রকাশ অনেকখানি নির্ভর করে। খাদ্যাভ্যাস পারিবারিক ভাবেই গড়ে উঠে। চর্বিযুক্ত ফাস্ট্ফুড় (বার্গার, পিংজা ইত্যাদি) খাওয়া, ফল, ও অপরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট (লাল চালের ভাত) না খাওয়া, অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় পান করা; দামী রেস্তারায় খাওয়ার আগে ক্ষুধাবর্ধক ও খাওয়ার শেষে চর্বি ও চিনিযুক্ত ডেসার্ট (dessert) খাওয়া।
৩. আবেগ : বিষণ্নতা, আশাহীনতা, ক্রাধ, একঘেয়েমি জনিত বিরক্তি, নিজেকে ছোট ভাবা প্রভূতি মানষিক কারণে ক্রমাগত অভিযোজন করার ফলে স্থূলতা দেখা দিতে পারে ।
৪. কর্মক্ষেত্র : চাকুরিজীবীদের ক্ষেত্রে ঠাই বসে থেকে কাজ করা এবং সহকর্মীদের চাপে ফাস্টফুড বা এ জাতীয় খাবার অতিভোজন করার ফলে স্থুলতা দেখা দিতে পারে ।কাজ শেষে পায়ে হেটে বা সাহকেলে না চেপ গাড়ি করে বাসায় ফেরা।
৫. মানসিক আঘাত : দুঃখজনক ঘটনাবলী, যেমন-শৈশবকালীন শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার; পিতা-মাতা হারানোর বেদনা কিংবা বৈবাহিক বা পারিবারিক সমস্যা ইত্যাদি অতিভোজন কে উস্কে দেই।
৬. বিশ্রাম: বিশ্রাম এর সময় বাসায় বসে কেবল রিমোট-কন্ট্রোলার টিভি দেখা, ইন্টারনেট ব্রাউজ করা বা কম্পউটারে গেম খেলার কারণে কায়িক পরিশ্রমের অভাবে স্থুলতা দেখা দেয়।
৭. কতক ওষুধ : কিছু ওষুধ স্থুলিতার সম্ভাবনাকে বাড়াতে পারে, যেমন-কটিকোস্টেরয়েডস, বিষন্নতা দূর করার ওষুধ (অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস), জন্মবিরতিকরণ বড়ি প্রভৃতি। তাছাড়া ইনসুলিন ও কিছু ডায়াবেটিক প্রতিষেধক ওষুধও স্থুলতা সৃষ্টি করে ।
স্থূলতার কারণে সাস্থগত সমস্যা (Health Problem of Obesity):
১. স্থূলতার কারণে মানুষের গড় আয়ুসকাল ৬-৭ বছর কুমে যায়।
২. স্থলতার কারণে উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে বেশি কোলেস্টরল, উচ্চ ট্রাইগ্রিসারাইডের মাত্রা বেড়ে যায়।
৩. দেহের মেদের পরিমাণ বেড়ে গেলে ইনসূলিনের সাড়া প্রদান হ্রাস পায় । ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে ।
৪. অতিরিক্ত মেদের কারণে পুরুষদের ৬৪% ও মেয়েদের ৭৭%/ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৫. স্থুলতার কারণে মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে হার্ট ডিজিজ, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হার্ট ফেইলিওর, গর্ভাবস্থায় জটিলতা, ঋতুস্রাবজনিত অসুস্থতা, বন্ধ্যাত্ব, বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, অস্টিওআর্থহিটিস, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রটি ইত্যাদি। স্থুলতার চিকিৎসার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি নতুন শাখা সৃষ্টি হয়েছে। একে বেরিয়াটিকস (Eariaties) বলে । বিজ্ঞানের এই শাখায় স্থুলতার কারণ, প্রতিরোধ চিকিৎসা ও অস্ত্রপ্রচার সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়।
স্থূলতার কারণ (Prevention of Obesity):
স্থুলতাজনিত ঝুঁকির মধ্য কেউ থাক বা না থাক সবারই এ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। স্থুলতা প্রতিরোধের জন্য-
১. নিয়মিত ব্যায়াম : সপ্তাহে অন্তত ১৫০-২৫০ মিনিট দ্রুত হাঁটা বা সাঁতার কাটার অভ্যাস করতে হবে।
২. স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যগ্রহণ : কম ক্যালোরি ও পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল, সবজি ও গোটা শস্য দানা গ্রহণ করতে হবে।
৩, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ : চর্বিযুক্ত খাবার, মিষ্টিসমৃদ্ধ আহার গ্রহণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অ্যালকোহল গ্রহণ নিষিদ্ধ করতে হবে।
৪. লোভনীয় খাবার পরিহার : লোভনীয় খাবারের দিকে হাত বাড়ানো ঠিক নয়। ভুক্তভোগীরা যেন আহার গ্রহণের তাদের জন্য নির্ধারিত খাবার তালিকা কঠোরভাবে মেনে চলেন সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
৫, দেহের ওজন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা : প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত অন্তত একবার নিজের ওজন মেপে দেখতে হবে রুটিন অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণের প্রভাব কতখানি সফল হয়ে়ছে। দীর্ঘমেয়াদী ফল পেতে হলে খাদ্য ও ব্যায়াম সংক্রান্ত তালিকার প্রতি অটল ও বিশ্বস্ত থাকতে হবে।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ ব্যবহৃত করতে হবে । স্থুলতা প্রতিকারে মানুষ আজ ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচারেও পিছপা হচ্ছে না ।
______
0 Comments